শনিবার, ২০ মার্চ, ২০১০

দেশভাগের নেপথ্যে : বাংলার প্রেক্ষাপট

দেশভাগের সময় বাংলাভাগের প্রধান কারণ হিসাবে, মূলতঃ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশালী বর্ণহিন্দুদের, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার অনীহাকে দায়ি করার একটি জনপ্রিয় প্রচার, মূলতঃ বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু তথাকথিত বামপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সক্রিয় আছে। আমি এখানে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করে, দেখাতে চেষ্টা করবো, বাংলাভাগের প্রকৃত পটভূমি কিভাবে রচিত হয়েছিল।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতে, ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের (Government of India act, 1935) আওতায়, বাংলায় যে প্রাদেশিক সংবিধান (Provincial Constitution) প্রযোজ্য হয়েছিল, সেখানে আইনসভা (Legislative Assembly) নির্বাচন সংক্রান্ত ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য বৈষম্য লক্ষ করা যায়। বাংলার আইনসভার ২৫০টি আসন যে ভাবে ভাগ করা হয়েছিল তা হল :

১) ১১৭টি আসন কেবলমাত্র মুসলমান ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত মুসলমান প্রতিনিধিদের জন্য।
২) ৪৮টি আসন সাধারন জনতার ভোটে নির্বাচিত, বাংলায় বসবাসকারী যে কোন প্রতিনিধির জন্য।
৩) ৩০টি আসন সাধারন জনতার ভোটে নির্বাচিত হিন্দু তফসিলি প্রতিনিধিদের জন্য।
৪) ১৯টি আসন শিল্প ও বানিজ্যমহলের দ্বারা নির্বাচিত, তাদেরই প্রতিনিধিদের জন্য।
৫) ১১টি আসন বাংলায় বসবাসকারী ইউরোপিয়ানদের দ্বারা নির্বাচিত, তাদেরই প্রতিনিধিদের জন্য।
৬) ৮টি আসন শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত, তাদেরই প্রতিনিধিদের জন্য।
৭) ৫টি আসন জমিদারদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য।
৮) ৩টি আসন অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের প্রতিনিধিদের জন্য।
৯) ২টি আসন ভারতীয় খ্রীষ্টানদের জন্য।
১০) ২টি আসন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১১) ২টি মহিলাদের জন্য।
১২) ২টি মুসলমান মহিলাদের জন্য।
১৩) ১টি অ্যাংলোইন্ডিয়ান মহিলাদের জন্য।

এর ফল হিসাবে দেখা গেল, বাঙ্গালী হিন্দুরা সর্বাধিক ১১৭টি (২৫০ - ১১৭ - ১১ - ২ - ২ - ১) আসনে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এই ১১৭টির মধ্যেও আবার ৩০টি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত ছিল, যা বাস্তব পরিস্থিতির সাথে আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অন্যদিকে বাঙ্গালী মুসলমানরা সর্বাধিক ২০৩টি (১১৭ + ৪৮ + ১৯ + ৮ + ৫ + ২ + ২ + ২) আসনে, যার মধ্যে ১১৭টি আসনের প্রার্থী, শুধুমাত্র মুসলমান ভোটারদের ভোটেই নির্বাচিত হবে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারি অনুসারে দেখা যাচ্ছে, বাংলার মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত মোট জনসংখ্যার ৫২% থেকে ৫৪%-এর মধ্যে ছিল। সুতরাং ২০৩ - ১১৭ আসনের অনুপাত যে বাস্তব জনসংখ্যার অনুপাতের সঙ্গে সঙ্গতিহীন এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি বাংলায় ব্রিটিশদের জনসংখ্যার অনুপাত ০.০০০৪%-এরও কম হলেও, তাদের জন্য আইনসভার ৪% আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল।
বাঙ্গলার হিন্দুদের পক্ষে পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে পর, যখন দেখা গেল ১১৭টি আসনের সবকটিতেও হিন্দু প্রতিনিধিরা জিতে উঠতে পারে নি। তা স্বত্বেও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সর্ববৃহৎ দল হিসাবে আইনসভায় আত্মপ্রকাশ করে। তাদের পরেই ছিল মুসলিম লিগ এবং তৃতীয় স্থানে ছিল ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। এমতাবস্থায় একটি জোট সরকার অনিবার্য হয়ে পড়ে ও ফজলুল হক কংগ্রেসকে কোয়ালিশন সরকার গড়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, ক্ষমতা ভাগ করে নিয়ে কোয়ালিশান সরকার গড়তে অস্বীকার করে। ফলতঃ কৃষক প্রজা পার্টি, মুসলিম লিগের সঙ্গে কোয়ালিশান সরকার গড়তে বাধ্য হয় ও মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তাদের মূল সংস্কারমুখী কর্মসূচি থেকে দূরে সরে যায়। পরে ১৯৪১-এ মুসলিগের লিগের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এলেও, ফজলুল হকের পক্ষে দেশভাগের প্রক্রিয়া রোখা আর সম্ভব হয় নি, কারণ তাঁর নিজের সংগঠন কৃষক প্রজা পার্টির বেশির ভাগটাই তখন মুসলিম লিগ গ্রাস করে নিয়েছে, এবং ব্রিটিশ সরকারও মুসলিম লিগের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেআইনি উপায়ে বলপ্রয়োগ করা শুরু করেছে। এই অবস্থায় কিছু বর্ণহিন্দু ও তফসিলি হিন্দু প্রতিনিধিও, ক্ষমতার লোভ বা যে কারনেই হোক হক-লিগ মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এভাবেই ১৯৩৫-এর ভারত সরকার আইন, বাঙ্গালি হিন্দুদের প্রায় সম্পূর্ণভাবে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত করে। অন্যদিকে কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী স্বার্থপরতা, বাঙ্গালীকে মুসলিম লিগের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সামনে প্রতিরোধের শেষ সুযোগটুকু থেকে বঞ্চিত করে। আসামে কিন্তু কংগ্রেস কোয়ালিশান সরকারে গিয়ে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছিল। তাই আসামের ঐক্য, শেষ পর্যন্ত বিপন্ন হয় নি।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তখনও যে হিন্দু বাঙ্গালী দেশভাগের পক্ষ নেয়নি, তা কিন্তু শুধুমাত্র বাঙ্গলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার আশাতেই। কিন্তু ১৯৪৩ সালে ফজলুল হককে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে বলপ্রয়োগ করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লিগ ক্ষমতা দখল করতে পারে, মূলতঃ ব্রিটিশ প্রভুর বদান্যতাতেই। এবার সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ১২১টি করা হয়, যার মধ্যে মুসলিম লিগ জয়লাভ করে ১১৪টিতে। ইউরোপিয়ান ও অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলি কাজে লাগিয়ে, লিগ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় ব্রিটিশ শাসক। মুখ্যমন্ত্রীর পদ নেন কুখ্যাত সোহরাওয়ার্দি। ১৬ই আগস্ট জিন্না Direct Action Day ঘোষনা করলে, সোহরাওয়ার্দি এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষনা করেন, যাতে দাঙ্গা করতে সুবিধা হয়। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার ভয়াবহতায় যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের আবহ তৈরী করেছিল, তারপরে আর হিন্দু বাঙ্গালির দেশভাগের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কিছু করার ছিল না।

1 টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

মুসলিম লিগকে বৃটিশরা খেলিয়েছিল এটা সত্য। আর তাদের আশা ছিল দেশটা ভাগ হলে, অন্তত একটা ভাগকে যদি হাতে রাখা যায়, বা দুটকেই দুটোর বিরুদ্ধে খেলিয়ে যদি দুটকেই হাতে রাখা যায়, যেটি এখন আমেরিকা করছে। কিন্তু কথা হলো, শরৎ বসু ফজলুল হ'ক দের প্রয়াস তেমন সমর্থণও পায় নি। ফজলুল হক বা সুরাবর্দীদের (? নামটা ঠিক লিখলামতো) সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও অন্য হিন্দু নেতারা নিজেদের জন্যে জনসংখ্যানুপাতে সংরক্ষণের দাবি তুলে দেশভাগটাকে আটকালেন না কেন? অহঙে বেঁধেছিল? দায়িত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে কি?